বিদ্যুৎ বিশ্লেষণ
তখন আমি ক্লাস ফোর কি ফাইভে অধ্যায়নরত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীমনোভাবাপন্ন এক ব্যক্তিত্ব। যদিও আমার গবেষনার বেশিরভাগই ছিলো জলীয় উপাদান। গবেষনার স্বার্থেই তাই দিনের বেশিরভাগ সময় পুকুর-নালায় ডুবাডুবি এবং মাছ ধরা নিয়া ব্যস্ত সময় কাটাইতে হইত। মৎস্যকূলের মনঃস্তাত্ত্বিক বিন্যাস হইতে লইয়া তাহাদের কোন প্রজাতিকে কিভাবে খালি হাতে, বরশি দিয়া কিংবা গামছা প্রয়োগে পাকড়াও করিতে হইবে, এই সকল বহুবিধ বিষয়েই আমার গবেষনার ক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল। তবে আমার এই জলজ গবেষনা এবং এলাকার অন্যান্য আদমসন্তানদের আমার গবেষনামূলক প্রতিভার প্রতি সম্মান, কোনকিছুরই তোয়াক্কা না করিয়া আমার মহান মাতৃদেবী মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্য দিবালোকে জনাসম্মুখে পুকুর হইতে তুলিয়া আমাকে কানে ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া বাসায় ফেরত লইয়া যাইতেন।
সেই সময় মুন্সীগঞ্জ শহরে গ্যাসীয় ব্যবস্থাপনা তেমন একটা ছিল না বিধায় প্রায় সকলের বাসাতেই কেরোসিনের স্টোভ কিংবা ইলেক্ট্রিক হিটার ব্যবহারে রন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিতে হইত। আমাদের বাসাতেও তাই সিলিন্ডার গ্যাসের পাশাপাশি স্টোভ এবং ইলেক্ট্রিক হিটার, দুইখানাই বহাল তবিয়তে বিদ্যমান ছিল। আমার গবেষনার বড় একটা অংশ তৎকালীন সময়ে রান্নাঘরেও কাটিত বটে। স্টোভ এবং হিটার হইতে লইয়া তরকারীর কাঁটাকাটি উচ্ছিষ্ট, কোন কিছুই আমাকে কম আকৃষ্ট করিত না।
কথায় আছে "ভর দুক্কুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা"। তো সেইদিন নিঝুম দুপুরে আমার মাথাতেও যেন ভূতের ঢেলাই পড়িল একখানা। বেশি কিছুদিন যাবতই হিটার লইয়া একখানা চিন্তা মাথায় ঘুরিতেছিল। হিটারে তো বিদ্যুত রূপান্তরিত হইয়া তাপে পরিণত হয়। যেই তাপে কিনা রান্নাবান্না সমাধা হইয়া থাকে। কিন্তু তাপে রূপান্তরিত হইবার পরেও কি সেইখানে বিদ্যুত বলিয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে? মানে হিটারে হাত দিলে তো হাত পুড়িবেই, জানা কথা। কিন্তু সেইসাথে ইলেক্ট্রিক শকও খাইব কিনা উহাই ছিল আমার গবেষনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এবং তাহা প্রমানের পদ্ধতিও একখানাই জানিতাম, যাহাকে বলে হাতেকলমে পরীক্ষণ। কয়দিন ধরিয়াই তাই ভাবিতেছিলাম যে হিটারে হাত দিয়া তাহা পরীক্ষা করিয়া লইব কিনা। কিন্তু কোনমতেই সাহসে কুলাইতেছিল না। তো সেইদিন ঠিক করিলাম যাহা হয় হইবে, কিন্তু আজ আমি দেখিয়াই ছাড়িব কি হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। মনে মনে নিজেকে বোকা বলিয়া গালমন্দ করিতে করিতেই রান্নাঘরে গিয়া হাজির হইলাম। "আরে বেকুব, তুই জানিসই যে আগুনে হাত দিলে হাত পুড়িবেই, তাহার পরেও উল্লুকের মত হাত দিতে চাইতেছিস?! তোর কি আর এই জীবনে আক্কেল বলিয়া কোন পদার্থ মস্তিষ্কে গজাইবে না?" নিজেকে এহেন গালমন্দ করিতে করিতেই হিটারের সুইচ অন করিলাম। এবং হিটারের লোহিত বর্ণের কয়েল দেখিতে দেখিতেই সম্মোহিত হইয়া একসময় যা হয় হইবে ভাবিয়া কয়েলে হাত দিয়া বসিলাম। ব্যস, এর পরে আমার যতটুকু স্বরণে আসে আমার পুরা দেহ উড়িয়া গিয়া পিছনের দেয়ালে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা খাইল। এবং ঐখানেই বেশ কয়েক মিনিট আমি অবশ হইয়া পড়িয়া থাকিলাম। এক সময় ধীরে ধীরে হুশ ফিরিল। বুঝিলাম যে এহেন মারাত্মক শক আমি পূর্বে আর কখনও খাই নাই। হাত তুলিয়া দেখি যে আঙ্গুলেরও কিছুটা অংশ ভালমতই পুড়িয়া গিয়াছে। পুরা মাথাই ফাঁকা ফাঁকা লাগিতেছিল, কিন্তু বুকটা ভারী ভারী বোধ হইতেছিল। এমন একখানা কান্ড ঘটাইয়া বসিলাম, ইহা এখন কাউকে না বলিতে পারিলে যেন বুকের ভার হালকা হইবে না।
অতএব বিক্ষিপ্ত পদচারণায় বেডরুমে গিয়া হাজির হইলাম। এবং ঠেলিয়া গুঁতাইয়া আমার মাতৃদেবীর নিদ্রাভঙ্গের প্রয়াস পাইতে লাগিলাম। অবাধ্য নাবালক সন্তানকে এহেন অভদ্রের ন্যায় দুপুরের সুখনিদ্রা ভঙ্গের কারন হিসাবে আবিস্কার করিয়া মাতৃদেবী নাতিশয় বিরক্তির সহিত চক্ষু তুলিয়া তাকাইলেন, এবং জানিতে চাহিলেন এই অশোভন কান্ডের হেতু কি। আমিও হড়বড় করিয়া আমার সুমহান কৃতকর্মের বৃত্তান্তকরতঃ ফলাফলস্বরূপ আমার পোড়া হাত প্রদর্শন করিলাম। "বোকা ছেলে কোথাকার! যাও, গিয়া ওষুধ লাগাও হাতে" বলিয়া মাতৃদেবী চরম বিরক্তির সহিত মাথা নাড়াইয়া অন্যদিকে কাত হইয়া আবার নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হইলেন। আর আমি পাশের রুমে গিয়া দুই গালে হাত রাখিয়া খাটের উপর উপবিষ্ট হইয়া ফ্যালফ্যালে দুই চোখ শূন্যে নিবিষ্ট করিয়া জগত এবং জীবন লইয়া নানাবিধ আধ্যাতিক ভাবনা ভাবিতে লাগিলাম।
৬টি মন্তব্য
মন্তব্য করুন