আমার শিক্ষক জীবন - সূত্রপাত
ছাত্র থাকিতে থাকিতে হঠাৎ করিয়াই একদিন আমি নিজেকে শিক্ষকরূপে আবিস্কার করিয়া বসিলাম। কি অদ্ভুত! কি কিম্ভুতকিমাশ্চর্যম সেই অভিজ্ঞতা!! ভাগ্যিস খুব বেশিদিন এই অভিজ্ঞতা আমাকে সঞ্চয় করিতে হয় নাই। তবে অল্প দিনেই বহুবিধ বিচিত্র ঘটনায় হাড়ে হাড়ে টের পাইয়া গেলাম শিক্ষক হওয়া কাহাকে বলে, বিশেষ করিয়া হাই স্কুলের অল্পবয়েসী ব্যাচেলর শিক্ষকের বিড়ম্বনা কত প্রকার ও কি কি।
যাই হোক, শুরু হইতেই বরং খোলাসা করি। ঘটনার সূত্রপাত এখন হইতে সাত বছর পূর্বে। আমি কেবল আমার ডিগ্রী কমপ্লিট করিয়া দেশে ফিরিয়া হাওয়া খাইয়া বেড়াইতেছি। বয়স আর কতই হইবে, ২২-২৩ এর মতো। দেখিয়া অবশ্য আরও ছোট, মানে ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্র মনে হইত আমাকে। তো তখনই হঠাৎ করিয়া এলাকার স্বনামখ্যাত হাইস্কুল আমাকে তাহাদের কম্পিউটার বিভাগে শিক্ষকরূপে জয়েন করিয়া কৃতার্থ হইবার প্রস্তাব পেশ করিয়া বসিল। আহা! যেই স্কুলে আমি নিজেই একসময় ছাত্ররূপে বিচরণ করিয়াছি, সেইখানেই শিক্ষক হিসাবে পদচারণা করিব? ভাবিতেই আহলাদে গদগদ হইয়া মাস্টার্সে ভর্তি হইবার আগে পর্যন্ত কয়েকমাস শিক্ষকতা করিতে আমি রাজি হইয়া গেলাম। বলিতে গেলে আমাকে দিয়াই এই স্কুলে কম্পিউটার বিভাগ চালু হইল সেই বছর হইতে।
স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের আলাদাভাবে মর্নিং এবং ডে শিফটে ক্লাস হইলেও আমার সুবিধার্থে ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়ে সবাইকে একসাথে লইয়া ক্লাস করিবার ব্যবস্থা করা হইল। যথাসময়ে আমি মাঞ্জা মারিয়া স্কুলে গিয়া হাজির হইলাম। শত হইলেও শিক্ষক বলিয়া কথা। মনে একখানা বীরবিক্রম ভাব। ভাবখানা এইরকম যে, বাচ্চাদের ক্লাস লইব, এ আর এমন কি! তখন মর্নিং, মানে মর্নিং শিফটে বালিকাদের ক্লাস চলিতেছিল। তো কলেজ সেকশনের প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে লইয়া রওয়ানা হইলেন ছাত্রীদের সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দিবার নিমিত্তে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকিয়াই রুমভর্তি অর্ধশত ছাত্রীর জুলুজুলু অনুসন্ধানী নেত্রের সম্মুখে নিজেকে আবিষ্কার করিয়া মনে মনে একখানা ধাক্কামতো খাইলাম। বুক কেমন যেন ধরফর করিতে লাগিল, আর হাত-পা যেন অনেকটা অবশ হইয়া আসিল। (যদিও বাহিরে তাহা কোনমতেই প্রকাশ পাইতে দেই নাই)। আয়হায়, বালিকা কোথায়? ইহা তো দেখি একদল চঞ্চল কিশোরীর পাল্লায় আসিয়া পড়িয়াছি! উহাদের অনেকের দুষ্ট দৃষ্টি এবং মুচকি মুচকি হাসি দেখিয়াই টের পাইলাম যে ভবিষ্যতে ইহাদের সামলাইতে আমার মতো নিরীহ গোবেচারা এক শিক্ষকের জন্যে কি দূর্গতি অপেক্ষা করিতেছে। এরই মাঝে প্রিন্সিপাল স্যার আমার পরিচয় প্রদান করিলেন। অতঃপর আমার বহুবিধ গুনাগুণ বৃত্তান্ত করিতে করিতেই কাহার ডাকে যেন আমাকে রুমে রাখিয়াই তিনি প্রস্থান করিলেন। ব্যস, রুমের মধ্যে শুরু হইয়া গেলো ফিসফিস গুঞ্জন, কানাকানি এবং মুখ টিপিয়া হাসাহাসি। বুঝিতে পারিলাম নতুন শিক্ষকের ব্যপার লইয়াই তাহাদের মধ্যে এহেন ভাবের আদান প্রদান হইতেছে। (তাহাদের ভাবখানা এমন যে এই বাচ্চা আবার শিক্ষক হইল কেমন করিয়া)! কি আর করা, মূর্তির ন্যয় দাড়াইয়া মুখে একখানা কাষ্ঠ হাসি ঝুলাইয়া তাহাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম চুপচাপ। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিন্সিপাল স্যার আসিয়া আমাকে উদ্ধার করিলেন এই কঠিন অবস্থা হইতে। অতঃপর আমার ব্যপারে আরও কিছু মহান উক্তি উদ্ধৃত করিয়া আমাকে লইয়া তিনি রুম হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
বাহির হইয়া ক্ষণিকের জন্যে হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলেও এইবার মস্তিষ্কে নতুন শংকার উদয় হইল। এই কয়খানা ছাত্রীকে সামলাইতেই তো ক্লাসে আমাকে হিমশিম খাইতে হইবে, উহাদের সহিত যদি ছাত্র সকলেও যুক্ত হয়, যেইখানে উহাদের একসাথে ক্লাস করিবার ইহা ছাড়া অন্য কোন সুযোগ নাই, এই সকল দামালের বেয়াড়াপনা আমি সামলাইবো কিভাবে? অতএব শিঘ্রই কর্তৃপক্ষের নিকট আরজি পেশ করিলাম, স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদিগকে আলাদা পড়াইবার নীতি সমুন্বত রাখিবার নিমিত্তে আমিও আলাদাভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস লইতে চাই, যদিও ইহাতে আমাকে কষ্ট করিয়া একই ক্লাস দুইবার লইতে হইবে। আমার এই নীতিবোধে কর্তৃপক্ষ যে যরপরনাই অভিভূত হইয়াছিলেন, তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না।
অতএব শুরু হইল আমার শিক্ষক জীবন। প্রথম দিন কেবল ছাত্রীদের ক্লাস লইলাম। ক্লাসের সময় হইতেই বিভিন্ন শাখা হইতে কম্পিউটারের ছাত্রীরা কিচিরমিচির করিতে করিতে ক্লাসে আসিয়া প্রবেশ করিল। অতঃপর স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার আরও কয়েকজন মান্যগন্য শিক্ষকের সহিত আমাকে লইয়া অনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন বর্ক্তৃতার পর আমাকে ক্লাসে রাখিয়া চলিয়া আসিলেন। ইহাই আমার প্রথম ক্লাস, তাই ভাবিলাম শুরুতে পরিচয়ের পালা সাঙ্গ করি। আমার ব্যপারে অন্যেরা যা বলিয়াছে ইহার পরে আরও বলিবার মতো কিছু বাকি থাকে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রীসকলের পরিচয় লইবার নিমিত্তে একের পর এক তাহাদের নাম জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। কিন্তু পঞ্চান্ন জন ছাত্রীর নাম দূরে থাকুক, ছয়-সাতজনের নাম জানিতে না জানিতেই উহারা মগজে এমন গুবলেট পাকাইয়া গেল যে কোনমতেই আর কাহারও সঠিক নামখানা আমি ঠিকমতো বলিতে পারিলাম না। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখিয়া তো ছাত্রীরা হাসিতে গড়াগড়ি খাইতে লাগিল। অতএব পরিচয়ের পর্বে ক্ষান্ত দিয়া 'নামে নয় কাজে পরিচয়' স্লোগানের সহিত আমি ক্লাসে মনোনিবেশ করিলাম।
চেয়ারে বসিয়া ছাত্রীদের রুল কল করিতেছি। এমতাবস্থায় হঠাৎ করিয়া পিছনের দরজা হইতে গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনিয়া চমকাইয়া ফিরিয়া তাকাইলাম। এবং সেইখানে প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখিয়া প্রায় কার্টুনের মতোই লম্ফ দিয়া সটান হইয়া দাড়াইয়া গেলাম। স্যারের ইশারায় ক্লাসরুম হইতে বাহির হইয়া যাইতে না যাইতেই পিছনে ছাত্রীদের অট্টহাসির হুল্লোড় শুনিতে পাইলাম। স্যার তো ক্লাসের কুশলাদি জানিতে চাহিয়া আমাকে ভরসা দিয়া চলিয়া গেলেন। আর আমি দেখিলাম শুরুতেই ছাত্র-ছাত্রীরা লাই পাইয়া মাথায় উঠিয়া গেলে পরে আমার খবর হইয়া যাইবে। অতএব এইবার ক্লাসে ঢুকিয়াই চোখমুখ পাকাইয়া সবাইকে এক কঠিন ধমকের সহিত ঠান্ডা করিয়া দিলাম। অতঃপর জাতির উদ্দেশ্যে নাতিদীর্ঘ একখানা বর্ক্তৃতা দিয়া ফেলিলাম, যাহার মর্মার্থ হইতেছেঃ "ক্লাসে যাহা বলিবার তাহা আমি বলিব, এবং তোমাদের কাহারও কিছু বলিবার থাকিলে, তাহাও কেবল আমার সহিতই বলিবে। অন্যথায় যাহারা নিজেরা কথা বলিতে চাও, তাহাদের জন্যে দরজা খোলা রহিয়াছে, নির্দিধায় নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতে পার। ইহাতে আমি কিছুই মনে করিব না, কিংবা কাউকে কোন অভিযোগও করিব না। এছাড়া যাহাদের আমার ক্লাস ভাল লাগিবে না, তাহারাও যেই কোন সময়ে বাহির হইয়া যাইতে পার। কিন্তু ক্লাসে থাকিয়া নিয়ম ভঙ্গ করা চলিবে না।" ব্যস, এরপর হইতে ক্লাসে আর কখনোই ডিসিপ্লিন লইয়া তেমন কোন সমস্যায় নিপতিত হইতে হয় নাই। (ছেলেদের প্রথম ক্লাসেও অবশ্য একইভাবে ঝারি দিতে হইয়াছিল, এবং ছাত্রী হইতে যে ছাত্র সামলানো আরও ঝামেলার কর্ম সেই দিব্যজ্ঞান লাভেও আমার বেশিদিন দেরী হয় নাই)।
তো এইভাবেই শুরু হইল আমার শিক্ষক জীবন। এবং পরবর্তী কয়েক মাসে এত্তোরকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলাম যাহা অল্প কথায় বলিয়া শেষ করা যাইবে না। যেই কারনেই হোক, অল্পদিনেই শিক্ষক হিসাবে আমার নাম ছড়াইয়া গেলো এলাকায়। যাহাদের আমি কখনও দেখি নাই, তাহারাও আমার নাম শুনিয়া বলে "আচ্ছা! আপনেই তাহা হইলে সেই কম্পিউটার স্যার?" অনেক ছাত্রছাত্রীরই মন্তব্য কানে আসিত যে আজ অমুক স্যারের ক্লাস আছে বলিয়াই স্কুলে আসিলাম। বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও কম হয় নাই। ক্লাসরুমে যাওয়া আসার পথে করিডরে বিভিন্ন ছাত্রীর কতোরকম মন্তব্য যে শুনিয়াছি তাহার অনেকগুলা আমি হয়তো কখনোই কাউকে বলিবো না। সব স্কুলেই বিভিন্ন শিক্ষকদের যেমন কিছু ছাত্রপ্রদত্ত নাম থাকে, আমাকেও তেমনি সকলে মিলিয়া নাকি একখানা ব্যঙ্গাত্বক নাম দিয়াছিল। কিন্তু বহু চেষ্টা করিয়াও সেই নাম আমি কাহারও কাছ হইতে উদ্ধার করিতে পারি নাই।
মজার ব্যপার হইলো শিঘ্রই আমার ছোটবোন স্কুলের বড় আপুদের আদরের পাত্রী হইয়া গেল। টিফিন পিরিয়ডে বিভিন্ন ক্লাসের আপুরা তাহাকে বিভিন্ন রকম খাবার আনিয়া আপ্যায়ন করিতে লাগিল। বাসার একতলায় ভাড়া থাকিতো এইট ও টেন পড়ুয়া দুই বোন, তাহারাও অল্প দিনেই তাহাদের ক্লাসের মধ্যমনি হইয়া উঠিল। অনেকেই আসিয়া তাহাদের চাপিয়া ধরিতো আমার সহিত পরিচয় করাইয়া দিতে। তবে কাহারও ব্যপারে সুনাম রটিতে যতোখানি সময় লাগে, কুৎসা রটিতেও তাহা হইতে বেশি সময় লাগে না। ফলে আমার ক্ষেত্রেও ইহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। এইসব লইয়াও মজার মজার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হইয়াছে। কিন্তু উহা হয়তো পরে কখনও সুযোগ পাইলে বলিবো।
৪টি মন্তব্য
মন্তব্য করুন