My Blog

The following post has been published in www.tarunyo.com website.

বোরখা সমাচার




কিছুদিন হলো ব্যবসা করার মহান পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে চাকরি ছেড়ে ঘরে এসে কেবল গ্যাঁট হয়ে বসেছি। ব্যবসা মানে যদিও ব্যক্তিগতভাবে মক্কেলদের সফটওয়্যার কিংবা ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়া, ব্যবসার নামে দিনের বেশিরভাগ সময় আমাদের একতলার কম্পিউটার ক্লাবে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়াই আমার মূল কাজে পরিণত হলো। তবে ক্লাবে শুধুমাত্র আড্ডা বা কম্পিউটার গেমই খেলা হতো না, এলাকাবাসীর কম্পিউটারজ্ঞান উন্নত করার লক্ষ্যে কিছু শিক্ষক রেখে কম্পিউটার কোচিং-এর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিলো।

তো সেদিন ক্লাবের অফিসরুমে বসে একা একাই মাছি তাড়াচ্ছিলাম। এমন সময় পাশের বাসার পুঁচকে ছোড়া জুয়েল এসে গুলগুলা চেহারা নিয়ে উঁকি দিলো। তার ফাজিল ফাজিল ভাব দেখেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে এই ত্যাঁদড় এখন কম্পিউটারে গেম খেলার জন্য আমাকে ফুসলানোর চেষ্টা তদবির করবে। অতএব আমিও ভাব ধরে একটু ঘুরে বসলাম। হেহ হে, কম্পিউটার খেলবে ভালো কথা, তাই বলে চাওয়া মাত্রই তা টুপ করে হাতে এসে পড়বে এখনও তা ততোটা সহজলভ্য হয়ে যায়নি। কিন্তু ছোকরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার যুক্তিজ্ঞানকে তুচ্ছ প্রমাণ করে বলা শুরু করলো যে তাদের এক এলাকাবাসী খালা এসেছেন তাদের বাসায় বেড়াতে। তো এই খালা নাকি তার কন্যাকে আমাদের ক্লাবের কম্পিউটার কোচিং-এ ভর্তি করাতে আগ্রহী। এব্যাপারে তিনি ক্লাবে এসে আমার সাথে বিস্তারিত আলাপ করতে চান। আহা! নতুন মক্কেলের আগমন!! কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য!!! এবার আমি নিজে গুলগুলা হয়ে চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসলাম। বললাম, শীঘ্রই খালাকে ক্লাবে নিয়ে আসো!

জুয়েল নিষ্ক্রান্ত হতেই আমি দ্রুত চেয়ার-টেবিল ঝাড়পোছ করে ঠিক করে সাজালাম। তারপর চেহারার মধ্যে বেশ প্রফেশনাল এক ব্যবসায়ীর ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে করতে খালার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়েলের সাথে খালা এসে হাজির হলেন। আপাদমস্তক খয়েরী বোরখা এবং নিকাবে আবৃত বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল সাইজের এক মহিলাকে খালা হিসেবে আবিষ্কার করে আমিও সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে ওনাকে ক্লাবে স্বাগত জানালাম। খালা ইশারায় সালামের উত্তর দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে হেলেদুলে চেয়ারে এসে বসলেন। আমি যখন জানতে চাইলাম যে তিনি তার মেয়েকে এখানে ভর্তি করাতে আগ্রহী কিনা, তিনি কেবল 'হু' বলে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। আমি বুঝলাম, বড়ই পর্দানশীন মহিলা, তাই আমার মতো পরপুরুষের সাথে কথা বলতেও মনে হয় তিনি সংকোচ বোধ করছেন। অতএব আমি একাই আমাদের কম্পিউটারের নানা কোর্সের গুণগান সম্পর্কে বকবক করতে লাগলাম। খালা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেন আর কেবল হু হা করেন। লেকচার দিতে দিতে খালার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা মনে পড়তে গিয়েও পড়ছিলো না আমার।

যাকগে, এতোকিছুতে মনোযোগ দেয়ার সময় কোথায়? বরং কম্পিউটার এবং আমাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নানা রকম জ্বালাময়ী বক্তব্যের শেষে যখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে মক্কেল বাগিয়ে ফেলেছি, তখন খালাকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমাদের বিশিষ্ট এই কোর্সগুলোর ঠিক কোনটিতে তিনি তার মেয়েকে ভর্তি করতে চান। এতোক্ষণ খালা চুপচাপ আমার লেকচার শুনতে থাকলেও এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে তিনি বোরখার অবগুণ্ঠন খুলে ফেললেন। জুয়েল তো হাসির চোটে মাটিতেই গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আর আমি পুরো টাশকি খেয়ে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে খালার(!) দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর মস্তিষ্ক সচল হলে নিজেও তাদের সাথে দমকা হাসির হুল্লোড়ে যোগ দিয়ে হাসির বেগে কাঁপা শুরু করলাম। আয়হায়, শেষ পর্যন্ত এও ছিলো আমার কপালে?!

কিসের কোর্স, কিসের কি! ক্লাবে তালা ঝুলিয়ে আমরা তিনজন হাসতে হাসতেই জুয়েলদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে অপেক্ষারত জুয়েলের মা ও ভাইবোনদের বাকিরাও অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আমি নিজেও নিজের বোকামির কথা ভাবতে ভাবতে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলাম। শত হলেও নিজের মাতৃদেবীকেই অপরিচিত খালা ভেবে পনের মিনিট লেকচার দিয়ে ফেলেছি, এমন ঘটনা তো জীবনে বারবার ঘটবে না!

পর্দার আড়ালের ঘটনা হচ্ছে এরকম। আমার মাতৃদেবী জুয়েলদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে জুয়েলের আম্মার নতুন কেনা বোরখা দেখে শখ করে গায়ে দিয়েছিলেন। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকেই তিনি নিজে আর চিনতে পারলেন না, তখনই আমাকে বিভ্রান্ত করার এই কূটবুদ্ধি ওনার মস্তিষ্কে উদ্ভাসিত হলো। (এটা নিশ্চিত যে আমার মাথার দুষ্টবুদ্ধিগুলোর ৫০ ভাগই আমার মাতৃজননীর কাছ থেকে আমদানিকৃত।) কিছুক্ষণের মধ্যেই করণীয় ঠিক করে তিনি জুয়েলকে ক্লাবে পাঠিয়ে দিলেন। এবং পরবর্তী ঘটনা তো ইতিপূর্বেই আপনারা অবগত হয়েছেন।

তবে এটাই আমার বোরখা নিয়ে বিড়ম্বনার একমাত্র ঘটনা না। একদিন বাসা থেকে বের হয়ে আমি কোথাও যাচ্ছিলাম। উলটো দিক থেকে দেখি নকশাকরা বোরখা পরিহিতা ছিপছিপে তন্বী এক তরুণী বান্ধবীদের সাথে এদিকেই আসছে। বোরখার আড়াল থেকে তার চোখের যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় যে কন্যা বেশ সুশ্রীই হবে। সাধারণত: রাস্তায় নারীজাতির মুখোমুখি হলে যা হয়, আমি আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার উল্টোপাশে চলে গেলাম। কন্যাকে পার হওয়ার সময় আড়চোখে দেখি যে কন্যাও সেই তখন থেকে আমাকেই দেখছে। আমি বরং না দেখার ভান করে হাটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু তাকে পার হয়ে যেতে না যেতেই কন্যা ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতে লাগলো, "এই মাজু (মেঝো ভাই), কোথায় যাচ্ছো? আমাকে দেখেও যে কিছু না বলে চলে যাচ্ছো?" আয়হায়, তরুণী কোথায়? এ যে দেখি আমার ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া আপন বোন! আমি চরম লজ্জায় ভ্যাবলার মতো আমতা আমতা করতে লাগলাম। আর তার বান্ধবীরা হাসতে হাসতেই খুন!

অতএব বৎসগণ, বুঝতেই পারছেন, বোরখার প্রতি এরপর আমার যদি কিছুটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েই থাকে (যেহেতু নিয়মিতই এটি আমাকে দুর্বল অবস্থানে ফেলে দেয়), তাতে অবাক হবার কিছু নেই। বোরখা দেখলেই তাই আমার মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, এবং এর আড়ালের মানুষটাকে ভালোমতো বোঝার জন্য সমস্ত চিন্তাভাবনা তাকে কেন্দ্র করেই সন্নিবেশিত হতে থাকে।


৬টি মন্তব্য


১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
Besh upobhogya . E bhabe bishoy ti bhebe dekhi ni . Bhalo laglo. Ar bhasha ekebare cholti hole bhalo hoto . Bhalo thakben.
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ধন্যবাদ। চলতি ও সাধু, দু'ভাবেই বিভিন্ন সময় লিখেছি। যেগুলো ইতিমধ্যেই সাধু ভাষায় লেখা হয়েছে, তা আর চলতিতে রূপান্তর করিনি।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩
অসাধারণ! খুবই উপভোগ করলাম।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ধন্যবাদ :)
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
রম্য রচনা হলেও এখানে চিন্তার অবকাশ আছে। বোরকার ওপারের মানুষটি কে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
সেটাই :)
জাফর
জাফর
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
আপনার কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগল, এভাবে যদি সকলে বুরখা পরে তাহলে সবাই সবাই কে এক চোখে দেখবে। আর তার মধ্যে সকল নারী জাতি তাদের সকল অধিকার পাবে
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ধন্যবাদ। তবে নারীদের এক চোখে দেখার জন্য শুধু বোরখা না, পুরুষদেরও এক চোখে দেখার মতো চোখ থাকতে হবে। তা না হলে বোরখা পড়েও কোন কাজ হবে বলে আমি মনে করি না।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ভালো লাগল। লেখাটি পড়ে প্রথম ভেবেছিলাম ঘটনা ভিন্ন দিকে যাবে।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
ধন্যবাদ। :)
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
চালায়া যান বোরখাওয়ালি কেউ হয়ত জোটে যাবে :p
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩
হা হা হা... অনেক আগেই জুটে গেছে... তবে বোরখাওয়ালী না... ;)
মন্তব্য করুন